১০ দিনের বেশি সময় ইন্টারনেট সংযোগ বিঘ্ন থাকায় দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং খাতে কর্মরতদের একটি অংশ। বর্তমানে ইন্টারনেট পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সহসাই দেশে ফিরছেন না তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এই পেশাজীবীরা। আগামীতে ইন্টারনেট আবার বন্ধ হবে না বা সংযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকার বিষয়ে আস্থাহীনতায় রয়েছেন তারা। তাই এখনই দেশে ফেরার মতো পরিবেশ নেই বলে মনে করেন তারা। প্রয়োজনে আরও কিছুদিন বিদেশে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চান। এমনকি বিদেশে অফিস চালু করার মতো বিকল্প আগ্রহ দেখাচ্ছেন আইটি উদ্যোক্তারা।
গত ১৭ জুলাই সন্ধ্যা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফোরজি মোবাইল ইন্টারনেট সীমিত করা হয়। ১৮ জুলাই সকাল থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয় মোবাইল ইন্টারনেট। একই দিন সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এতে চরম বিপাকে পড়েন আইটি-আইসিটি খাত সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী, ফ্রিল্যান্সার ও ব্যবসায়ীরা। এমন প্রেক্ষাপটে ভিসা আছে এমন ফ্রিল্যান্সার ও আইটি কর্মকর্তারা পাড়ি জমাতে থাকেন বিদেশে। দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য ভারত, দুবাই, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামকে বেছে নেন অনেকে। অনঅ্যারাইভাল ভিসা পাওয়ার সুযোগ থাকায় ফ্রিল্যান্সারদের একটি বড় অংশ পাড়ি জমান নেপালেও।
নেপালের ট্যুরিজম বোর্ড নিজেদের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানায়, শুধু জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৪৭০ জন পর্যটক নেপালে প্রবেশ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার পর্যটক জুলাই মাসের শেষ দুই সপ্তাহে প্রবেশ করেছেন বলে ইমিগ্রেশন বিভাগের বরাতে জানায় ট্যুরিজম বোর্ড। নেপালের একটি সূত্র কালবেলাকে জানিয়েছে, অন্তত ৬০০ জন ফ্রিল্যান্সার বা আইটি পেশাজীবী এই মুহূর্তে নেপালে অবস্থান করছেন। বিষয়টি নেপালের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতেও উঠে এসেছে।
এমনকি ২৩ জুলাই থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এবং ২৮ জুলাই থেকে ফোরজি মোবাইল ইন্টারনেট চালুর পরও দেশ ছাড়তে থাকেন অনেকে।
বরগুনার ফ্রিল্যান্সার ফাহাদ বিন হুসনে আলী ২৫ জুলাই চলে যান ভারতের দিল্লিতে। তিনি বলেন, ইন্টারনেট এখনো সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি। গ্রামের দিকে ইন্টারনেট সংযোগ এখনো স্থিতিশীল না। উপরন্তু, দেশে যে কোনো সময় আবার ইন্টারনেট বন্ধ বা ধীরগতির হতে পারে। গণগ্রেপ্তারে আটক হওয়ার ভয়ও আছে। নিজেকে প্রমাণ করতে করতে কাজ হাতছাড়া হয়ে যাবে। এমনিতেই সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বিদেশি গ্রাহকের কাছে। তাই দেশের বাইরে এসেছি এবং আরও কিছুদিন থাকতে চাই।
এভাবে কত দিন বাইরে থাকবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে এই ফ্রিল্যান্সার বলেন, নেপালে সবাই সহজেই প্রবেশ করতে পারে, ভিসার মেয়াদ বাড়ানো যায়। মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, উজবেকিস্তানসহ অনেক দেশে আমার প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। কত দিন বাইরে থাকব, সেটা নির্ভর করছে ইন্টারনেট কবে স্থিতিশীল হবে তার ওপর।
দেশীয় আরেকটি আইটি প্রতিষ্ঠান তার ৭ জন কর্মীকে পাঠিয়েছে নেপাল। সেই দলের সদস্য মোহাম্মদ নুর বৃহস্পতিবার হোয়াটসঅ্যাপে কালবেলাকে বলেন, শুধু দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য অফিস আমাদের নেপালে পাঠিয়েছে। ১১ আগস্ট রিটার্ন টিকিট কাটা। এর আগে ফিরছি না। তবে শুনেছি কোম্পানি আমাদের নেপালে থাকার মেয়াদ বাড়াতে পারে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে বিজনেস সলিউশন আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত এক প্রকৌশলী বলেন, ইন্টারনেট না থাকায় ৭ দিনে খুবই বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিদেশে থাকা গ্রাহককে আগে থেকে বলা যায় যে, নির্দিষ্ট একটি সময় আপনি থাকবেন না। কিন্তু হঠাৎ করে আপনি ম্যাপ থেকে গায়েব হয়ে যাবেন, কোনো ক্লায়েন্টই এটা মানবে না। কারণ আমার কাজের ওপর ভিত্তি করে তারা তাদের কাজের পরিকল্পনা করে। তাই নেপাল চলে আসছি। কবে ফিরবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনই ফেরার পরিকল্পনা নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশ থেকে ক্লায়েন্টদের কাছে কাজের প্রস্তাব যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আবার উদ্ভূত হলে (ব্যবসা) যতটুকু আছে, সেটাও থাকবে না। তাই কোম্পানি দেশের বাইরে কার্যক্রম পরিচালনার মতো বিকল্প নিয়ে ভাবছে।
এদিকে, দেশের বাইরে গিয়ে হলেও ফ্রিল্যান্সার এবং আইটি কোম্পানিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বাজার ধরে রাখার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন বেসিসের সাবেক পরিচালক রাশাদ কবীর। তিনি বলেন, ইন্টারনেট চালু যখন চালু হয় তখনো হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম বন্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ। ফলে ইন্টারনেট ফিরলেও আইটি পেশাজীবীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ছিল। তাই ক্লায়েন্ট ধরে রাখতে তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। আইটি পেশাজীবী ও আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্ট সবার মধ্যেই এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে যে, আগামীতে এমন কিছু হবে না। তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হবে।
জামায়াত নিষিদ্ধের ইস্যুতে দেশের পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হলে ইন্টারনেট সংযোগ আবারও বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখেন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ডা. তানজিবা রহমান। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত কোটা আন্দোলন শেষ হওয়ার পরিবেশ তৈরি হয়নি। উপরন্তু জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই আবার যদি সহিংসতা দেখা দেয় এবং পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়, তাহলে ইন্টারনেট সেবা আবারও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে চলতি মাসের মধ্যে পরিস্থিতি একটু হলেও ঠিক হবে বলে মনে করেন ডা. তানজিবা।