প্রিয়ন্তির বয়স ১৩ ছুঁই ছুঁই। উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। একদিন ক্লাস থেকে তাকে ডেকে বাসায় নিয়ে এলেন মা। ওই সময় বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন তিন মুরব্বি। প্রিয়ন্তি উঠানে পা রাখতেই মুরব্বিদের চোখেমুখে হাসির ঝিলক। প্রিয়ন্তির কানে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে বলা হলো, তুমি শুধু তিনবার কবুল বলো। ওই কথা শুনে প্রিয়ন্তি ৭-৮ বার কবুল বলে দিল। মোবাইলের অপরপ্রান্তে কবুল বলা ছেলেটা ইতালি প্রবাসী। ছোট্ট প্রিয়ন্তি বিয়ে বোঝে না। তবে পুতুলের মিছিমিছি বিয়ে দিয়েছে। মাসখানেক না যেতেই প্রবাসী স্বামী প্রিয়ন্তিকে তালাক দিল। প্রিয়ন্তি তালাকটাও ঠিকমতো বোঝেনি। প্রিয়ন্তি এখন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সবাই প্রিয়ন্তি নন, এমন হাজারও প্রিয়ন্তির জীবন ধ্বংস হচ্ছে ১ মিনিটের বিচ্ছেদে।
দাম্পত্যে মিল না হলেই যে বিচ্ছেদ সব সময়ে খুব সহজ হয়, তেমনটা নয়। সামাজিক বিয়ের সম্পর্কের সঙ্গে নানা বিষয় জড়িয়ে থাকে। কিন্তু প্রেমের বিয়ে কিংবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিয়ে-দাম্পত্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে এক প্রকার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব বিয়ের সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়ন কয়েক মিনিটের মধ্যেই হয়। আবার ১ মিনিটের মধ্যেই এসব বিয়ের অনেক বিচ্ছেদও ঘটছে। মোবাইলে বিয়ে প্রবাসী নারী-পুরুষের মধ্যেই ঘটছে।বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, প্রেম কিংবা ডিজিটাল বিয়ে ব্যক্তি (বর ও কনে) পর্যায়ের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়। পরিবার সদস্যদের পছন্দ-অপছন্দের মূল্যায়ন খুব একটা হয় না। ফলে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মোবাইলে বিয়ের প্রায় ক্ষেত্রে সংসার ও দেখাদেখিও হচ্ছে না, বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। আবার এমনও দম্পতি রয়েছেন, প্রেমের বিয়ে-হাজারও দুঃখ-দুর্দশা, চাওয়া-না পাওয়ার মধ্যেও যুগের পর যুগ টিকে আছে। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, বিবাহবিচ্ছেদ দিন দিন বাড়ছে।
রাজধানীর দুই সিটির তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে তালাকের আবেদন পড়েছে প্রায় ১৪ হাজার। ২০২২ এ ছিল ১৩ হাজার ২৮৮টি। গত ৫ বছরে তালাক হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার। এমন হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটছে প্রায় ৪০টি। অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে প্রতি ঘণ্টায় ১ দশমিক ৬৩। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন বলছে, দেড় যুগ ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে গ্রামে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক তানিয়া হক যুগান্তরকে বলেন, প্রেম এবং মোবাইলে বিয়ের অধিকাংশই বাল্যবিবাহ। এসব বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনাও বেশি। বিচ্ছেদের অধিকাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা থেকে আসছে। এমন বিয়ে ঘূণের মতো সম্পর্ককে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলে। কখনও কখনও সন্দেহপ্রবণতা থেকেও বিচ্ছেদ হচ্ছে। বিচ্ছেদের আবেদন নারীরা বেশি করছেন। মোবাইলে বিয়ে বন্ধ হওয়া উচিত। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় দায়িত্বরত এক কাজী জানান, এখন অধিকাংশ বিয়ের ক্ষেত্রে কাজীরা শুধু জড়পদার্থ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। কাবিন করাতে যা যা প্রয়োজন তা সঠিক কিনা যাচাইয়ের কোনো ক্ষমতাই থাকে না কাজীদের। বিয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্রপাত্রী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের পছন্দে বা দুই পরিবারের অভিভাবকদের পছন্দেই হোক জীবনসঙ্গী নির্বাচনে ভুল হলে মাসুল দিতেই হয়। দিন যত যাচ্ছে বিচ্ছেদ বাড়ছে।
বিচ্ছেদের বড় কারণ পরকীয়া : বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস নামের জরিপ বলছে, তালাক বা বিচ্ছেদের দুই ধরনের হার পাওয়া গেছে। একটি হলো স্থূল, যেটি মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিচ্ছেদের হার। অন্যটি সাধারণ বিচ্ছেদের হার-এতে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সিদের হিসাব করা হয়। বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়া। জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ২৩% এই কারণের কথা বলেছেন। আর দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতার কারণে ২২% বিচ্ছেদ হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে স্থূল বিচ্ছেদের হার ০.৬ থেকে ১.১%-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১.৪%-এ দাঁড়ায়। ২০২১ সালে নারীদের সাধারণ বিচ্ছেদের হার ছিল ২%-এর কিছুটা কম। সেটা পরের বছর বেড়ে ৩.৬%-এ দাঁড়ায়। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে হারটি ২০২১ সালে ছিল ২%-এর সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে হয় ৩.৮%।