প্রতি বছর রমজান মাসে মুসলিমরা রোজা রাখেন সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহারে বিরত থেকে। আরবি চান্দ্র বর্ষপঞ্জীর নবম মাস রমজান ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
গত প্রায় এক দশক ধরে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে রোজা পড়েছে গ্রীষ্মকালে। ফলে এসব দেশের মুসলিমদের রোজা রাখতে হয়েছে গরমের মধ্যে অনেক দীর্ঘসময় ধরে।
ইউরোপের কোন কোন দেশে কুড়ি ঘণ্টাও রোজা রাখতে হয়েছে। তবে চলতি বছর রমজান শুরু হয়েছে মার্চের প্রথম সপ্তাহের পর। ফলে বিগত বছরগুলোর চেয়ে তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক আবহাওয়ায় রোজা রাখছেন মুসলিমরা।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন যে একমাস ধরে রোজা রাখেন, তা তাদের শরীরে কী প্রভাব ফেলে?
প্রথম কয়েক দিন: সবচেয়ে কষ্টকর
শেষবার খাবার খাওয়ার পর আট ঘন্টা পার না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু মানুষের শরীরে সেই অর্থে উপোস বা রোজার প্রভাব পড়ে না।
আমরা যে খাবার খাই, পাকস্থলীতে তা পুরোপুরি হজম হতে এবং এর পুষ্টি শোষণ করতে অন্তত আট ঘন্টা সময় নেয় শরীর।
এই খাদ্য পুরোপুরি হজম হয়ে যাওয়ার পর, আমাদের শরীর যকৃৎ এবং মাংসপেশীতে সঞ্চিত চর্বি থেকে শক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে।
শরীর যখন এই চর্বি খরচ করতে শুরু করে, তা আমাদের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি— উভয়ই হ্রাস করে।
তবে যেহেতু রক্তে সুগার বা শর্করার মাত্রা কমে যায়, সে কারণে হয়তো খানিকটা দুর্বল এবং ঝিমুনির ভাব আসতে পারে। সেই সঙ্গে কারও কারও ক্ষেত্রে মাথাব্যাথা, মাথা ঘোরা, বমি বমি ভাব কিংবা নিশ্বাসে দুর্গন্ধ হতে পারে।
এ সময়টাতেই আসলে শরীরে সবচেয়ে বেশি ক্ষুধা লাগে।
৩ থেকে ৭ রোজা: পানিশূন্যতা থেকে সাবধান
প্রথম কয়েকদিনের পর আপনার শরীর যখন রোজায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, তখন শরীরে চর্বি গলে গিয়ে তা রক্তের শর্করায় পরিণত হচ্ছে।
কিন্তু রোজার সময় দিনের বেলায় যেহেতু আপনি কিছুই খেতে বা পান করতে পারছেন না, তাই রোজা ভাঙ্গার পর অবশ্যই আপনাকে সেটার ঘাটতি পূরণের জন্য প্রচুর পানি পান করতে হবে। নইলে আপনি মারাত্মক পানি-শূন্যতায় আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষ করে গরমের দিনে যদি শরীরে ঘাম হয়।
আর যে খাবার আপনি খাবেন, সেটাতেও যথেষ্ট শক্তিদায়ক খাবার থাকতে হবে। যেমন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা এবং চর্বি।
তবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাবার খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সব ধরণের পুষ্টি, প্রোটিন বা আমিষ, লবণ এবং পানি থাকবে।
৮ থেকে ১৫ রোজা: অভ্যস্ত হয়ে উঠছে শরীর
এই পর্যায়ে এসে আপনি নিশ্চয়ই অনুভব করতে পারছেন যে আপনার শরীর-মন ভালো লাগছে, কারণ রোজার সঙ্গে আপনার শরীর মানিয়ে নিতে শুরু করেছে।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ শহরের এডেনব্রুকস হাসপাতালের ‘অ্যানেসথেসিয়া এন্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের’ কনসালট্যান্ট ড. রাজিন মাহরুফ বিবিসিকে জানিয়েছেন, রোজার অন্যান্য সুফলও রয়েছে।
‘সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক বেশি ক্যালরিযুক্ত খাবার খাই এবং এর ফলে আমাদের শরীর অন্য অনেক কাজ ঠিকমত করতে পারে না, যেমন ধরুণ শরীর নিজেই নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে,’ বিবিসিকে বলেন ড. মাহরুফ।
‘কিন্তু রোজার সময় যেহেতু আমরা উপোস থাকছি, তাই শরীর তখন অন্যান্য কাজের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। কাজেই রোজা কিন্তু শরীরের জন্য বেশ উপকারী। এটি শরীরের ক্ষত সারিয়ে তোলা বা সংক্রমণ রোধে সাহায্য করতে পারে।’
১৬ থেকে ৩০ রোজা: ভারমুক্ত শরীর
রমজান মাসের দ্বিতীয়ার্ধে আপনার শরীর পুরোপুরি রোজার সঙ্গে মানিয়ে নেবে এবং দেহের পাচকতন্ত্র, যকৃৎ, কিডনি এবং দেহত্বক এখন এক ধরণের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাবে। সেখানে থেকে সব দূষিত বস্তু বেরিয়ে আপনার শরীর যেন শুদ্ধ হয়ে উঠবে।
‘এসময় আপনার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের পূর্ণ কর্মক্ষমতা ফিরে পাবে। আপনার স্মৃতি এবং মনোযোগের উন্নতি হবে এবং আপনি যেন শরীরে অনেক শক্তি পাবেন,’ বলেছেন ড. মাহরুফ।
‘শরীরের শক্তি জোগানোর জন্য আপনার আমিষের ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হবে না। যখন আপনার শরীর ‘ক্ষুধার্ত’ থাকছে তখন এটি শক্তির জন্য দেহের মাংসপেশীকে ব্যবহার করছে এবং এটি ঘটে যখন একটানা বহুদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে আপনি উপোস থাকছেন বা রোজা রাখছেন।’
‘যেহেতু রোজার সময় কেবল দিনের বেলাতেই আপনাকে না খেয়ে থাকতে হয়, তাই আমাদের শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট খাবার এবং তরল বা পানীয় গ্রহণের সুযোগ থাকছে রোজা ভাঙ্গার পর। সুযোগটির সদ্ব্যবহার করা হলে তা আমাদের মাংসপেশীকে রক্ষা করবে এবং একই সঙ্গে আমাদের ওজন কমাতেও সাহায্য করবে।’
তাহলে রোজা রাখা কি স্বাস্থ্যের জন্য ভাল?
ড. মাহরুফ বলেন, ‘অবশ্যই, তবে এখানে একটি ব্যাপার আছে।’
‘রোজা রাখা শরীরের জন্য ভালো, কারণ আমরা কী খাই এবং কখন খাই সেটার ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে সাহায্য করে। এক মাসের রোজা রাখা হয়তো ভালো। কিন্তু একটানা রোজা রেখে যাওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকরা দেবেন না।’
‘শরীরের ওজন কমানোর জন্য একটানা রোজা রাখা কোন উপায় হতে পারে না। কারণ একটা সময় আপনার শরীর তার সঞ্চিত চর্বি গলিয়ে শক্তিতে রূপান্তরের কাজ বন্ধ করে দেবে। তখন শক্তির জন্য শরীল নির্ভর করবে মাংসপেশীর ওপর। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। কারণ আপনার শরীর তখন ক্ষুধায় ভুগবে।”
ড. মাহরুফের পরামর্শ— রমজান মাসের পর মাঝে মধ্যে অন্যধরনের উপোস করা যেতে পারে। যেমন ৫:২ ডায়েট (পাঁচদিন কম খেয়ে দুদিন ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করা)। যেখানে কয়েকদিন রোজা রেখে আবার স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাওয়া-দাওয়া করা যেতে পারে।