নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে অযাচিত ‘সাকার ফিশ’

পুরো নাম সাকার মাউথ ক্যাটফিশ। বৈজ্ঞানিক নাম হিপোসটোমাস প্লেকোসটোমাস। মেক্সিকোর জেলেদের কাছে এই মাছ পরিচিত ডেভিল ফিশ নামে। আর আমাদের দেশে এর নাম সাকার ফিশ।

অ্যামাজনে ছিল এর বাস। এটি মূলত মিঠাপানির মাছ। অনেকে একে চেনেন অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছের ময়লা খেকো মাছ হিসেবে, কারণ শোভা বর্ধনের পাশাপাশি মাছের বর্জ্য এবং অ্যাকোয়ারিয়ামের অন্যান্য ময়লা খেয়ে ফেলে এই মাছ। গত কয়েক বছর ধরে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া যাচ্ছে একে। মেক্সিকোতে জেলেরা যে মাছ ধরেন তার ৭০ শতাংশই ডেভিডল ফিশ বা সাকার ফিশ।

বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীসহ দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে হরহামেশাই মাছটি উল্লেখযোগ্য আকারে দেখা যায়। দেখা মিলছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বিভিন্ন জলাশয়গুলোতেও। শখের মাছ পালনকারীদের অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে মুক্ত জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই মাছ।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রজাতির সাকার ফিশ ১৬-১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। মাছটি পানি ছাড়াই প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে।

দ্রুত বংশ বিস্তারকারী মাছটি জলজ পোকামাকড় ও শ্যাওলার পাশাপাশি ছোট মাছ এবং মাছের পোনা খেয়ে থাকে। এটি চিংড়ি, কালি বাউস, মাগুর ও শিং মাছসহ ছোট শামুক জাতীয় শক্ত খোলের প্রাণী খেয়ে সাবাড় করে ফেলে। তাছাড়া সাকার ফিশের পাখনা খুব ধারালো। ধারালো পাখনার আঘাতে সহজেই অন্য মাছের দেহে ক্ষত তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে পচন ধরে সেগুলো মারা যায়।

সাকার ফিশ রাক্ষুসে প্রজাতির না হলেও প্রচুর পরিমাণে খাবার ভক্ষণ করে। এতে দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্যের জোগান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না বিলুপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের। এটি ক্যাটফিম জাতের হওয়ায় জলাশয়ের একদম নিচের স্তরে বাস করে। ফলে এগুলোকে সরিয়ে ফেলাও বেশ কঠিন। ফলে মাছ চাষিদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মাছ।

মাছ চাষীরা অভিযোগ করেন, তাদের ঘেরে এই মাছ ঢুকে পড়ে চাষের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এর ব্যাপক বিস্তার ঘটলে দেশীয় প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন মৎস্য গবেষকরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাকার ফিশের প্রভাবে মায়ানমার ও আরব আমিরাতের মৎস্য চাষীরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে উপকূলীয় জেলাগুলোতে প্রথম এই মাছের দেখা মিলে। তবে এখন সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুরের মতো জায়গা যা উপকূল থেকে অনেক দূরে, সেখানেও দেখা মিলছে এই মাছের।

বিশেষজ্ঞরা জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এ মাছ খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন রোগ। তাই রাষ্ট্রপতির আদেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে দেশে ছড়িয়ে পড়া ক্ষতিকর সাকার মাছ চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশীদ বলেন, সাকার মাউথ ক্যাটফিশ মাছটি সহজেই নতুন পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হয়ে দ্রুত বংশ বিস্তার করতে সক্ষম। অনেকে শুরুর দিকে অ্যাকুরিয়াম ফিশ হিসেবে পালন করলেও পরবর্তীতে মাছটি বড় হয়ে গেলে তখন পুকুর বা ডোবায় ছেড়ে দেয়। সেখানে মাছটি নতুন পরিবেশে খাপ খেয়ে বংশ বিস্তার শুরু করে। মাছটি খেতে সুস্বাদু না হওয়ায় সাধারণত কেউ মাছটি খায় না এবং বাজারেও মাছটির কোনো চাহিদা নেই। মাছটি ভক্ষণে কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কিনা সে বিষয়ে এখনো কোনো গবেষণা হয়নি।

তিনি বলেন, এ মাছটি একবার কোনো জলাশয়ে ঢুকে পড়লে এর বিস্তার রোধ করা খুব কঠিন। চাষের পুকুরে এই মাছ ঢুকে পড়লে অন্য মাছের সঙ্গে খাবার ও বাসস্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। এতে করে বাইরে থেকে পর্যাপ্ত খাবার প্রদান করলেও কাঙ্ক্ষিত মাছের উৎপাদন পাওয়া যায় না। অন্যদিকে চাষযোগ্য মাছ সাকার ফিশের সঙ্গে খাবার ও বাসস্থানের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এভাবে মাছ চাষীরা লোকসানের মুখে পড়েন।

এদিকে প্রায় একইভাবে সাকার ফিশের বিস্তার ঘটে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতেও। সাকারের উৎপত্তিস্থল অ্যামাজনের গহীন বনে হলেও বর্তমানে মাছটি দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ব্যাপক বিস্তারের ফলে কিছুদিন ভোগান্তি পোহালেও বর্তমানে মাছটি থেকে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখছে মেক্সিকোর জেলেরা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইনসাইডার নিউজের এক প্রতিবেদনের বরাতে জানা যায়, মেক্সিকোতে এক সময় ডেভিল ফিশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সাকার মাউথ ক্যাটফিশকে প্রক্রিয়াজাত করে শুঁটকি বানিয়ে পোষা প্রাণীসহ কুকর-বিড়ালের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু কি তাই, সেই খাদ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে দেশটি। বর্তমানে দেশটিতে সাকার মাছ ঘিরে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এমনই দুই উদ্যোক্তা ভাই জুয়ান কার্লস ও ফ্রান্সিসকোর গল্প তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

পেশায় জেলে ফ্রান্সিসকো বলেন, এক সময় নদীতে জাল ফেললেই ঝাকে ঝাকে উঠতো সাকার মাছ, যার বাজারে কোনো দাম ছিলো না। বিষাক্ত ভেবে কেউ এই মাছ খেতো না। সেই সময়ে মারাত্বক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এরপর ২০১৪ সালে কয়েকজন গবেষকের সহযোগীতায় মাছটির পুষ্টিগুন ও উচ্চ প্রোটিনের বিষয় মাথায় রেখে প্রাণীখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এরপরই তাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে সাকার মাছ বিক্রি করেই আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি লাভ করছে এই দুই ভাই।

সাকার মাছ প্রক্রিয়াজাত করতে দেশটিতে ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে একাধিক প্রসেসিং ফার্ম। এসব ফার্মে জেলেদের থেকে মাছ সংগ্রহ করে মাছের ছাল ছাড়িয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে কাটা হয়। এরপর সেটি ফ্রিজিং করে শক্ত হয়ে আসলে আলাদা আলাদা টুকরোয় কেটে নিয়ে ড্রাই মেশিনে শুকানো হয়। পরবর্তীতে মাছের টুকরোগুলো শুকিয়ে এলে মোড়কজাত করা হয় সাকার ফিশের শুঁটকি।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফর্নিয়াসহ অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে সাকার ফিশের শুঁটকি পশুখাদ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে মেক্সিকো থেকে বিপুল পরিমাণে সাকার ফিশ শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে নদীগুলোতে সাকার ফিশের আধিক্যতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তাই এটিকে গলার কাটা হিসেবে বিবেচনা না করে উপযুক্ত গবেষণা এবং একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাক্ষুসে এই মাছটিকে কাজে লাগিয়ে নতুন শিল্পখাতের বিষয়টি আমলে নিতে পারে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *