নিউজ ডেস্ক: এবার বিকাশের সরাসরি হুন্ডির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দীর্ঘদিন ধরে বিকাশের এই চক্রটি বিকাশের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠিয়ে আসছিলো। ডিস্ট্রিবিউটরশিপের আড়ালে এই কাজটি করছিলেন ফেনীর চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজীব।
সূত্র জানিয়েছে, বনিটো কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজীব। এ প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস বিকাশের জেলা ডিস্ট্রিবিউটর। রাজীব ও তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা। এর মধ্যে গত এক বছরেই তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা। বিপুল এ অর্থের ৯৯ শতাংশই জমা হয়েছে নগদ টাকায়। এ নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা হওয়া এবং বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটরশিপের আড়ালে ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বিপরীতে লেনদেন হয়েছে বলে সন্দেহ করছে বিএফআইইউ। এ তথ্যের ভিত্তিতে অধিকতর অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি।
অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত বিএফআইইউর একাধিক কর্মকর্তা জানান, বনিটো কমিউনিকেশনের মালিক চৌধুরী আহমেদ রিয়াদ আজিজ রাজীবের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্বাভাবিক নয়। প্রতিষ্ঠানটি হুন্ডি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত। অন্তত ৩৪৬ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে বলে বিএফআইইউ প্রমাণ পেয়েছে। এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
চৌধুরী আহমেদ রিয়াদও স্বীকার করছেন তার ও নিজ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কুমিল্লার পর ফেনী ও নোয়াখালীতে প্রবাসী বেশি। তাদের ক্রয়ক্ষমতাও বেশি। কোনো প্রবাসীর টাকা যদি ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে এসে থাকে, সেটা আমাদের পক্ষে নির্ণয় সম্ভব নয়। তবে বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়। যা হুন্ডির পর্যায়ে পড়ে কীনা আমি জানি না বুঝিও না।’
রাজীবের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনা করে তৈরি করা অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, বনিটো কমিউনিকেশনের কর্মচারী মাহমুদুল ইসলাম, এনামুল হক, শহীদুজ্জামান বোরহান, সম্রাট, নিশান ও আশিকের মাধ্যমে ৩৭৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা সাউথইস্ট ব্যাংকের ফেনী শাখায় জমা করা হয়। এর মধ্যে শুধু মাহমুদুল ইসলাম একাই জমা দিয়েছেন ৩৪৬ কোটি ৮ লাখ টাকা। একইভাবে ঢাকা ব্যাংকের হিসাবে ৫ লাখ টাকার ওপর ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ফেনী শাখায় ৫ লাখ টাকার ওপর জমা হয়েছে ১২৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এনআরবিসিতে ৫ লাখ টাকার ওপর ১২৭ কোটি টাকা জমা করা হয়েছে। এভাবে এক বছরে রাজীব ও তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৯২৫ কোটি টাকা জমা হয়। তার ডিস্ট্রিবিউটর হাউজের এজেন্ট মা-বাবা স্টোর, ইসলাম অটো, ইউসুফ মেডিসিন কর্নারসহ ৪৬টি এজেন্টের মাধ্যমে বড় অংকের নগদ লেনদেন হয়েছে।
অনুসন্ধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত আর্থিক গোয়েন্দারা বলছেন, বিকাশের মাধ্যমে ডিজিটাল হুন্ডির ফলে বিদেশ থেকে যারা প্রবাসী আয় পাঠান তা বিদেশেই থেকে যায়। সে অর্থ পাচারকারীদের হাতে বিদেশে তুলে দেয়া হয়। আর দেশ থেকে যারা অর্থ পাচার করে, তারা তা হুন্ডি চক্রের হাতে তুলে দেয়। যখন কারো বিদেশে অর্থ পাচারের প্রয়োজন হয়, তখন শুধু ওই অর্থের মূল্য বিদেশে স্থানান্তর হয়। দেশীয় টাকার বিপরীতে বিদেশে ডলার পেয়ে যায় পাচারকারীরা। অবৈধ এ স্থানান্তরের ফলে ডলারের দাম বেড়ে যায়। প্রবাসী আয় যদি বৈধ পথে আসে তা দেশের ব্যাংকগুলোয় ডলার হিসেবে জমা হয়। বৈদেশিক মুদ্রার এ অর্থ রিজার্ভেও যুক্ত হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘বিকাশের অর্থ পাচার ও হুন্ডির তৎপরতা ঠেকাতে বিএফআইইউ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে বিএফআইইউ নিজে থেকে কারো বিরুদ্ধে মামলা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। তদন্ত করে আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রতিবেদন পাঠাই। হুন্ডির তত্পরতা রোধে আমরা সারা দেশে ব্যাংকিং চ্যানেল ও এমএফএসের ওপর নজরদারি বাড়িয়েছি।’
ফেনীর বনিটো কমিউনিকেশনসসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে বলে জানান সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুুন কবির। তিনি বলেন, ‘প্রবাসী আয় অবৈধ পথে দেশে আসার সম্ভাব্য পথগুলোর মধ্যে এমএফএসের মাধ্যমে ডিজিটাল হুন্ডি অন্যতম। এ ধরনের আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। এ ধরনের অর্থ পাচারের মতো অপরাধের ঘটনায় এরই মধ্যে ছয়টি মামলা হয়েছে। ফেনীর বনিটো কমিউনিকেশনসসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’