যেভাবে বাঙালী সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠল মঙ্গল শোভাযাত্রা

বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতিবারের ন্যায় এবারও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ১৪৩০ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে আনন্দে মাতবে সারা দেশ। নববর্ষের নানান আয়োজনের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তবে, শুধু বাঙালি সংস্কৃতির অংশ বললে ভুল হবে। কারণ এটি বিশ্ব সংস্কৃতিরও অংশ বটে। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুমোদনক্রমে ইউনেস্কো লিখে, “মঙ্গল শোভাযাত্রা হল জনসাধারণের একটি উৎসব যা ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে উদযাপন করা হয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দ্বারা আয়োজন করা হয়। ঐতিহ্যটি ১৯৮৯ সালে শুরু হয়, যখন সামরিক শাসনের অধীনে বসবাসরত হতাশ শিক্ষার্থীরা সম্প্রদায়কে একটি উন্নত ভবিষ্যতের আশা দিতে চেয়েছিল। এটির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে মুখোশ ও ভাসমান প্রতিকৃতি যা শক্তি, শান্তি এবং অগ্রগতির জন্য অশুভকে দূরে সরানোর প্রতীক। বিদ্যালয়ের দ্বারা ভাগভাগি করা জ্ঞানের উপাদানসহ, এটি জনসংহতি এবং গণতন্ত্রকে প্রচার করে।”

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো- আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হলেও আমরা অনেকে আজও এর (মঙ্গল শোভাযাত্রার) ইতিহাস জানিনা। তাই আজ আমরা জানবো কীভাবে বাঙালী সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠল মঙ্গল শোভাযাত্রা-

প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে ঢাকার রমনা পার্কে ছায়ানট আয়োজিত প্রাত্যোষিক সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং একে ঘিরে আয়োজিত অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা সাধারণ মানুষকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করতে থাকে এবং নাগরিক আবহে সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। ঐ বছরই ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করার উদ্যোগ প্রতি বছর অব্যাহত রাখে।

শোভাযাত্রার অনতম আকর্ষণ – বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল, হাতি, কুমীর, লক্ষ্মীপেঁচা, ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোশ এবং সাজসজ্জ্বা, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। সেই সময়ের সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়, পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে।

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল – পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা।

শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী সবার প্রচেষ্টায় এ উদ্যোগকে বৃহত্তর স্বার্থের ছায়াতলে নিয়ে আসার পরিকল্পনারও সূত্রপাত তখন। সে ধারাবাহিকতায় মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ আপামর মানুষের অংশগ্রহণে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আয়োজনে পরিণত হয়েছে।

এই বছর বাংলা ১৪৩০ সনকে বরণ করার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এ স্তবক ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’। প্রতিবারের মতো এবারো এক মাস আগে শুরু হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি পর্বের কাজ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। এবারের শোভাযাত্রার মোটিফ হিসেবে দেখা যাবে ময়ূর, বাঘ, টেপা পুতুল (মা ও শিশু), নীলগাই, হাতি ইত্যাদি। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার আহ্বায়ক শিল্পী নিসার হোসেন, যিনি বর্তমানে ডিন হিসেবে সমস্ত আয়োজন সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধান করছেন। অনুষদের শিক্ষক ও দুই বর্ষের শিক্ষার্থীদের সহায়তায় শোভাযাত্রার মূল নান্দনিক অংশ নির্মাণে তত্ত্বাবধান করছেন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য।

বাংলার লোকঐতিহ্য, পরম্পরাভিত্তিক চিত্ররীতি, বাংলার সরাচিত্র, পটচিত্র, শীতলপাটি, নকশিকাঁথা, শখের হাঁড়ি, বাংলা-বিহার-ওড়িশার নানা লোকচিত্র ধারা, মধুবনী চিত্রকলা আর এ সময়ের রিকশা পেইন্টিংসহ শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে শোভাযাত্রার মোটিফ নির্বাচন করা হয়। শোভাযাত্রা উপলক্ষে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় স্ট্রাকচার বা কাঠামো।

মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে চারুকলার শিক্ষার্থীদের মাসব্যাপী ছবি আঁকা ও মুখোশ তৈরি, সরাচিত্রসহ নানা নান্দনিক উপকরণ তৈরি ও চিত্রকর্ম বিক্রির আয়োজন করা হয়। নববর্ষ ঘিরে করা শিক্ষার্থীদের এসব কাজ বিক্রি করে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয় তা দিয়েই আয়োজিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এছাড়া দেশের বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে একটি আর্টক্যাম্পও হয়। এখানে অঙ্কিত ছবি বিক্রির অর্থ এ বৈশাখ উদযাপনের জন্য দেয়া হয়।

যুগ যুগ ধরে আমাদের গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন ধরনের পথনাটক, নৃত্য, যাত্রাপালা অনুষ্ঠানে মুখোশের ব্যবহার হয়ে আসছে। মুখোশ আদিম লোকশিল্প। চৈত্রসংক্রান্তিতে মুখোশ পরে নৃত্য প্রাচীন সংস্কৃতির অংশ। সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে এবং উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মূলত বাঘ, পেঁচা, হাতি, আর রাজা-রানীর মুখোশই প্রধান। মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য মুখোশ তৈরি হয় দুভাবে। এক. আগে মাটির ছাঁচ তৈরি করে আঠা দিয়ে কাগজ লাগিয়ে কয়েকটি স্তর তৈরি করা হয়। দুই. কাগজ কেটে মুখোশ তৈরি এবং তার ওপর রঙ দিয়ে বিভিন্ন নকশা অঙ্কন।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রা উৎসবটি ইউনেস্কোর বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভের পর ২০১৭ সাল থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে কলকাতায়ও মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই চারুকলার শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা চিত্রশিল্পীদের নিজস্ব প্রয়াসে এ শোভাযাত্রা আজ হয়ে উঠেছে বিশ্বের ঐতিহ্য। আমাদের সংস্কৃতিকে করে তুলেছে ঋদ্ধ। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে আয়োজিত চারুকলার এ মঙ্গল শোভাযাত্রা সর্বজনীন উৎসব; যার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয় নববর্ষের শুভ উত্থান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *