• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৩:১২ অপরাহ্ন
Notice
We are Updating Our Website

হবিগঞ্জে শুঁটকির উৎপাদন কমেছে প্রায় ১১ গুণ

নিজস্ব প্রতিবেদক
আপডেট : রবিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ কমে যাওয়া, কাঁচা মাছের চাহিদা বৃদ্ধি এবং সরকারি সহায়তার অপ্রতুলতার কারণে হবিগঞ্জের হাওর অঞ্চলে শুঁটকির উৎপাদন গত এক দশকের তুলনায় প্রায় ১১ গুণ কমেছে। ২০২০ সালে জেলায় শুঁটকির উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪৫ টন, যা এক দশক আগে ছিল ৫০০ টন।

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার দিঘলবাগ গ্রামের প্রতাপ চন্দ্র দাস। ৫ বছর আগেও প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১২০০ কেজি মাছ শুঁটকি করতেন। সেই সুদিন এখন আর তার নেই। মাছ সংকটে হাজার কেজির হিসেব এ বছর ঠেকেছে শ’র কোটায়। তাই আগামী বছর থেকে শুঁটকি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা করছেন তিনি।

প্রতাপ চন্দ্র দাস বলেন, ‘একসময় আমরার গ্রামের ৬০% পরিবার কম বেশি শুঁটকি বানাইত। এখন হাওরো মাছ নাই। যে কারণে কেউ শুঁটকি করে না। ইবছর মাত্র ৩টা পরিবার শুঁটকি করতেছে। তাও আগের মতো না।’

তিনি বলেন, ‘৫ বছর আগের হিসাব কার দরকার নাই। গত বছরও প্রতিদিন ১০০ কেজি মাছ শুকাইছি। ইবছর এক সাপ্তায়ও ১০০ কেজি মাছ পাই না। এগুলা কইরা এখন লস। তাই ভাবতাছি আগামী বছর আর করতাম না।’

দিঘলবাগ গ্রামের মতোই উপজেলার নোয়াগাঁও, বিরাট, কোদালিয়া, বদলপুরসহ শুঁটকি উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ সবগুলো গ্রামের একই অবস্থা। এসব গ্রামের অধিকাংশ পরিবার শুঁটকি উৎপাদনে জড়িত থাকলেও এখন দুয়েকটি পরিবার ছাড়া কেউ শুঁটকি করেন না।

আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং এবং লাখাই উপজেলার প্রতিটি জেলে পল্লীতেই অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত হতো শুঁটকির উৎপাদন। খোলা মাঠ কিংবা জলাশয়ের পাশে উঁচু মাচাং বেঁধে (স্থানীয় ভাষায় ডাঙাই) মাছ শুকানো হতো। একসময় বড় বড় বোয়াল, শোল, গজার, বাইমসহ নানা প্রজাতির দেশীয় মাছের শুঁটকি তৈরী হলেও গত ৫ বছর ধরে শুধু পুঁটি মাছের শুঁটকিই তৈরী হয় এখানে।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এক দশক আগে জেলায় ৫ হাজার পরিবার শুঁটকি উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে তা নেমে এসেছে একশ’র নিচে। তখন প্রতি বছর শুঁটকি উৎপাদন হতো অন্তত ৫০০ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ছিল ১০ কোটি টাকার বেশি। তবে বর্তমানে জেলায় শুঁটকির উৎপাদন কমেছে এক-চতুর্থাংশের বেশি।

গত দুই যুগ ধরেই শুঁটকির উৎপাদন নিম্নমুখী ছিল। তবে সর্বশেষ ৫ বছরে তা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। ২০১৭ সালে জেলায় শুঁটকির উৎপাদন হয় ২০০ মেট্রিক টন। মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই তা নেমে আসে অর্ধেকে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে উৎপাদন হয় মাত্র ১০০ মেট্রিক টন, ২০১৯ সালে ৬৬ মেট্রিক টন এবং ২০২০ সালে উৎপাদন হয় ৪৫ মেট্রিক টন। ২০২১ ও ২০২২ সালে শুঁটকি উৎপাদনের কোন তথ্যই সংগ্রহ করেনি মৎস্য অধিদপ্তর।

শুঁটকি উৎপাদনে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, হাওরে মাছ কমে যাওয়াই শুঁটকি উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। এছাড়া শুঁটকির দাম কম ও যথেষ্ট পরিমাণে সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ায় ধ্বংসের পথে এ খাত।

শুঁটকি উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ের বিভিন্ন দেশী প্রজাতির মাছ। প্রশ্ন হল্‌ কতটা কমেছে হাওরের মাছের পরিমাণ?

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে- জেলায় প্রাকৃতিক জলাশয়ের পরিমাণ ৮১ হাজার ৬৭১ হেক্টর। এক দশক আগে (২০১২ সালে) দেশীয় মাছের উৎপাদন ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৩ মেট্রিক টন। যা বর্তমানে (২০২২ সালে) এসে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ১৬৭ মেট্রিক টনে। অর্থাৎ গেল এক দশকে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন কমেছে ৭ হাজার ৫২৬ মেট্রিক টন।

জেলায় খাবারের জন্য কাঁচা মাছের চাহিদা বছরে ৪৫ হাজার ৯২ দশমিক ১২ মেট্রিক টন। উৎপাদন ৪৯ হাজার ৩৭৬ দশমিক ৪৬ মেট্রিক টন। যার মধ্যে প্রাকৃতিক জলাশয়ে ২৬ হাজার ১৬৭ এবং পুকুরে চাষ ২১ হাজার ৮৫৩ মেট্রিক টন।

বর্তমানে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার দিঘলবাগ, বিরাট ও কাকাইলছেও, বানিয়াচং উপজেলার হারুনী, ঝিলুয়া, আড়িয়ামুকুড়, ইকরাম এলাকার ৩টি গ্রাম এবং লাখাই উপজেলার একটি গ্রামে শুঁটকির উৎপাদন হয়। এছাড়া হবিগঞ্জ শহরের উপনগরে মৎস্য আড়তের পাশে দুইজন ব্যবসায়ি শুঁটকি তৈলীর সাথে জড়িত রয়েছেন।

বানিয়াচং উপজেলার ইকরাম এলাকার আমজাদ হোসেন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শুঁটকি ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘১০ বছর আগে ট্রাক লোড করে শুঁটকি ঢাকা-চট্টগ্রাম পাঠাতাম। গত দুই বছর ধরে যে পরিমাণ শুঁটকি কিনতে পারি তা হবিগঞ্জের বাজারগুলোতেই বিক্রি হয়। মাঝেমধ্যে হবিগঞ্জের বাজারেও সাপ্লাই দিতে সংকটে পড়ে যাই।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নদী, খাল, বিল, হাওর কমে আসছে। এখন হাওরে মাছই খুব একটা পাওয়া যায় না। খাবারের মাছের বড় জোগান দেয় চাষ করা মাছ। যে কারণে শুঁটকি কমে আসছে। হয়তো কয়েক বছর পর আর দেশী মাছের শুঁটকি পাওয়া যাবে না। সাগরের মাছের শুঁটকিতেই স্বাদ নিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে জেলায় কী পরিমাণ শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে তার কোন তথ্য অফিসে নেই। আর এই বছরও কোন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। অন্য বছর গুণগত মানের শুঁটকি উৎপাদনে জেলেদের প্রশিক্ষণ দিলেও এবার আমরা প্রশিক্ষণার্থীই পাইনি।’


আপনার মতামত লিখুন :
এ জাতীয় আরও খবর