নারীও ছিল রাজভোগ্য! ইতিহাস সাক্ষী। প্রাচীন যুগের শাসকের চোখে একজন নারী অলঙ্কার, অর্থ, জমির মতোই বিবেচিত হতো। যার হাতে ক্ষমতা সেই অধিকার পাবে নারীর। এছাড়াও নানা ভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে নারীদের। আর একথা বলতে বসলে এসে পড়বেই সেকালের ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যে স্তন করের কথা।
ব্রাহ্মণরা ছাড়া স্তন ঢেকে রাখার অনুমতি ছিল না কারো। ঢাকলেই দিতে হতো কর। এই ঘৃণ্য আইন শেষ পর্যন্ত যে নারীর জন্য রদ করা হয়েছিল তিনি নাঙ্গেলি। এই দলিত রমণীর নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। নিজের প্রাণ দিয়ে তিনি যেভাবে নারীর মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা যেমন করুণ, তেমন এক গর্বের ইতিহাস।
সেকথা বলার আগে বলার দরকার কেমন ছিল সেযুগের ত্রিবাঙ্কুরের রাজশক্তি? কর বসানোয় তাদের জুড়ি মেলা ছিল ভার। মৎস্যজীবীদের জাল রাখার জন্য কর দিতে হতো। আবার গোঁফ রাখার জন্যও ছিল করের নিদান। অলঙ্কার পরতে গেলেও দিতে হতো কর। সব মিলিয়ে ১১০ রকমের কর। দরিদ্র প্রান্তিককে শোষণের ‘অভাবনীয়’ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ত্রিবাঙ্কুর। যার মধ্যে অন্যতম তালাক্করম। বাংলা করলে দাঁড়ায় মাথার জন্য কর। আর ছিল মুলাক্করম। অর্থাৎ স্তন কর। আগেই বলা হয়েছে, সেটা কী ব্যাপার। বুক ঢাকতে পারবেন না কোনো অব্রাহ্মণ নারী। এই করেরও রকমফের ছিল। স্তনের আকার অনুযায়ী ঠিক হতো করের অঙ্ক। যাদের স্তনের আকার ছোট, তাদের থেকে বেশি কর দিতে হত গুরুস্তনীদের। কৈশোরের সূচনায় স্তনুদ্গমের সময় থেকেই শুরু হতো এই কর।
বলাই বাহুল্য, এ ছিল শোষণের এক নগ্ন প্রকাশ। সমাজের প্রান্তিক মানুষদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে দমনপীড় চলতো। এভাবেই চলছিল। তারপর একদিন একজন রুখে দাঁড়াতেই… ইতিহাস বারবার এমন মুহূর্ত দেখেছে। স্তন করের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রতিবাদের সেই মুখের নাম নাঙ্গেলি। ইজাভা সম্প্রদায়ের দলিত এক রমণী।
নাঙ্গেলি ও তার স্বামী চিরুকানন্দন বাস করতেন রাজ্যের উপকূলবর্তী এক ছোট্ট গ্রামে। সেই গ্রামের নাম চেরথালা। ক্ষেতমজুর হিসেবে কাজ করতেন তারা। এই পরিস্থিতিতে একদিন আচমকাই জ্বলে উঠলেন নাঙ্গেলি। যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিলেন দীর্ঘ শোষণ ও বঞ্চনার মোকাবিলা করতে।
ঠিক কী ঘটেছিল সেই দিন? স্থানীয় এক সরকারি কর্মী পর্বরতিয়ার দলিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কর সংগ্রহ করতেন। স্তন করের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। নাঙ্গেলিও মনে মনে ফুঁসছিলেন রাগে। কর দিতে দিতে জেরবার হয়ে যেতে হচ্ছিল। একেই উপার্জন নামমাত্র। তার উপর করের অত্যাচার। এহেন পরিস্থিতিতে দুইমুঠো অন্ন জোগাড় করতেই নাভিশ্বাসের জোগাড় হতে হচ্ছিল। তাই একদিন আগ্নেয়গিরির লাভা উদগীরণের মতোই নাঙ্গেলির মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠাটা বোধহয় স্রেফ সময়েরই অপেক্ষা ছিল।
নাঙ্গেলির অনুমান ভুল ছিল না। দ্রুতই রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে যায় আতঙ্কপ্রবাহ। পাশাপাশি জ্বলতে শুরু করে বিদ্রোহের আগুনও। এতদিনের অবদমিত কণ্ঠগুলি যেন কী এক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠল। আর একথা তো জানাই, সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদ জাগ্রত হলে রাষ্ট্রশক্তি ভীত হয়। এক্ষেত্রেও তাই হল। তৎকালীন রাজা বাধ্য হলেন স্তন কর প্রথা তুলে নিতে। একজনের প্রাণের বিনিময়ে এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেলেন অসহায় দলিত মানুষরা।
ভারতীয় একটি গণমাধ্যমের তথ্য, মেয়েটি ১৮৫৯ সালে ভারতে সংগঠিত কাপড় দাঙ্গার বীজ বপন করে যায়। নিজের জীবনের বিনিময়ে অগণিত অসহায় নারীকে রক্ষা করে নাঙ্গেলি। সেও পারতো বাকি সব নারীদের মতো স্তনশুল্ক মেনে নিতে। শুল্ক দেওয়ার মতো সক্ষমতাও তার ছিল। কিন্তু পৃথিবীতে কেউ কেউ বুকে আগুন নিয়ে জন্মায়। কোনো অন্যায় তাদের সামনে আসলেও তা তাদের বুকে স্থান পায় না, বুকের আগুনে ভস্মিভূত হয়ে যায় সব অন্যায়। কাহিনী এখানেই শেষ নয়…নাঙ্গেলির শরীর তখনও চিতায় দাউদাউ করে জ্বলছে! হঠাৎ একটা লোক দৌড়ে এসে সেই চিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে! লোকটা নাঙ্গেলির স্বামী। ভারতের ইতিহাসে, স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া কোনো পুরুষের এটাই প্রথম এবং শেষ ঘটনা।
সূত্র: সংবাদ প্রতিদিন