ফুলের সাথেই মেলবন্ধন তার। জন্মেছিলেন বসন্তে। চলে গেলেন শরতে। এই দুই ঋতুতে বাংলাদেশ ফুলে ফুলে ভরে যায়। শরতের অসংখ্য বুনোফুলের ওপর অশ্রুর মতো লেগে থাকে শিশিরের ফোঁটা। টুঙ্গিপাড়ার নদীজল-ঘাস, রোদ ও শিশির আজ কেমন আছে!
সারা বাংলাদেশ যাকে বুকে ধরে রেখেছে, এক শ’ বছর পর ওই নদীজলে ধোয়া ভূমির ভাষা জানতে চায় বাঙালি। বাঙালির মন রোদ ও শিশিরে যুগলবন্দী। চৈত্রের চোঁ চোঁ রোদ আর শরতের নমিত আঁচ। রক্তে ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য ভরা বাঙালির মনকে পড়তে পেরেছিলেন জাতির পিতা।
পিতাই পড়তে পারেন।
তাই তিনি গড়তেও পারেন।
আজ এই দিনে, এই পলল বাংলার সমস্ত আয়তন জুড়ে তার দীর্ঘ ছায়া। এই ছায়ার বিস্তার আজ তার নির্মাণকে ছাড়িয়ে সারা বিশ্বজুড়ে।
১৯২০ সাল থেকে ১৯৭৫ – সময়ের ফ্রেমটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বতন্ত্র অধ্যায়। ঔপনিবেশিকতার দুই শক্ত দেয়ালকে ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলার অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের এক ও একক ব্যক্তিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সঙ্গে ছিলো সাড়ে সাত কোটি মানুষ – নিরন্ন, নির্যাতিত, আশ্রয়হীন তারা। ঠিকানাবিহীন মানুষ। মানচিত্রবিহীন বিপন্ন বাঙালি।
বঙ্গবন্ধু উজান স্রোতের আগে পেছনের ইতিহাস পড়ে নিয়েছিলেন। বইয়ের ইতিহাস নয়। অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্ত্বার ওঠা-পড়ার ইতিহাস পড়তে পেরেছিলেন। তারপর তিনি এগিয়ে গেছেন উজান স্রোতে, প্রতিটি বাঙালি জানে। তিনি এগিয়েছেন এবং জাতিরাষ্ট্রে যাওয়ার পথ নির্মাণ করেছেন। অনন্য পথটি তাকে নিজেই নির্মাণ করে নিতে হয়েছে।
কারণ, মুক্তির উৎসমুখে পৌঁছার পথটি নির্মিত ছিলো না। ছয় দফার দর্শন এর মধ্যে আগুনের স্ফূলিঙ্গ ছিলো। অথচ তা জোনাকির মতো। নেভে-জ্বলে আর পথ দেখায়। বাঙালির মানসপট প্রস্তুতি ও জাতিরাষ্ট্রের দলিল তার মধ্যেই আছে। তাই হয়তো ছয় দফাকে ‘ম্যাগনাকার্টা’ বা বাঙালির মুক্তির সনদের সাথে তুলনা করা হয়।
তারও আগে পুরো ষাটের দশকজুড়ে একের পর এক মাইলফলক স্থাপন করেছেন ও পেরিয়ে এসেছেন। শৃঙ্খলিত বাঙালির কিছুই ছিলো না শৃঙ্খল ভিন্ন। কিন্তু তারা জেনে গিয়েছিল শৃঙ্খল ছেঁড়ার মানুষকে তারা পেয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাসকে তাড়িয়ে তারা মুক্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল।
তাদের চোখে তখন স্বপ্ন।
শুধুই মুক্তির স্বপ্ন।
একটি ডাকের অপেক্ষা শুধু।
সময়ান্তরে সেই ডাক ঠিক এসেছিল।
১৯৭০ থেকে ১৯৭১ এর মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ সমাধান আর চাপানো যুদ্ধের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দ্বিধা বা দোলাচলে ভোগেননি। দুই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি প্রেক্ষাপট প্রস্তুত রেখেছিলেন। নিরস্ত্র বাঙালির হাতে ছয় দফার শানানো অস্ত্র দিয়ে সংগ্রামের জন্য তাদের মনকে প্রস্তুত রেখেছিলেন তিনি। ১৯৭০ প্রথম সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর তিনি সংকটের শান্তিপূর্ন সমাধানই আশা করছিলেন।
ইতিহাসকে রচনা করা যায় না। সময়ের অনিবার্য সামাজিক-রাজনৈতিক উপাদান ইতিহাস রচনা করে, তিনি জানতেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর এড়িয়ে পাকিস্তান নাটকের রঙ্গমঞ্চ খাড়া করে। গণহত্যা দিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়।
তার আগেই স্বাধিকার আদায়ের লড়াইটি বাঙালি মানসে মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়েছিল। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা। ছয় দফার মধ্যেই তার বীজ উপ্ত ছিলো। অগ্নিগর্ভ বাঙালি অসহিষ্ণু হয়নি। প্রিয় নেতার ডাকের জন্য অপেক্ষা করেছে।
ডাক এলো ৭ মার্চ।
মাত্র ১৯ মিনিটের কথা কাব্য। বলিষ্ঠ ও নিবিড়।
১৯ মিনিটের ডাক বিপ্লবের সুপ্ত বীজকে অঙ্কুরিত করে বাঙালি মানসকে ৯ মাসের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্বোধিত করেছিল। স্বাধীনতার ডাক – গণজোয়ার।
ভূমিষ্ঠ হলো বাংলাদেশ। স্বাধীন পতাকা-শোভিত স্বাধীন মানচিত্র
এই ভূমি-চিত্র বাঙালির মনে হাজার বছর ধরে লেখা ছিলো। ভূমিপুত্র বঙ্গবন্ধু তাকে রক্তের অক্ষরে পৃথিবীর বুকে নিপুণ চিত্রকরের মতো এঁকে দিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
জন্মদিনে তারই আঁকা মানচিত্র থেকে – বসন্ত ও শরতে ফোঁটা দশ মিলিয়ন অথবা তারও বেশি ফুল থেকে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে যাই।