ডেস্ক রিপোর্টঃ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক ভাষণ দেওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। একদিকে ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা; অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী এ দেশের আপামর জনগণের যেন স্বপ্নভঙ্গ না হয়, সেদিকটা রক্ষা করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে দুই বিপরীতমুখী চাওয়ার এক বিস্ময়কর সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হন।
ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা, বুদ্ধিদীপ্ত অবস্থান রাজনীতিতে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এমনটাই মনে করেন দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও গবেষকরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁরা এমন অভিমত জানিয়েছেন।
তাঁরা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণের আগে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সঙ্গেও কথা বলেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। সবার সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধু নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভাষণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে নিজের দৃঢ় অবস্থানের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি তাঁর ভাষণে এ দেশের স্বাধীনতার বিষয়ে নিজের অবস্থান যেমন জানান, তেমনি পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার দরজাও খোলা রাখেন।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, “বঙ্গবন্ধু তাঁর এই ভাষণের মধ্য দিয়ে একদিকে পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অন্যদিকে শোষণের হাত থেকে বাঙালিকে মুক্তির পথনির্দেশনা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণেই বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ তিনি পাড়া, মহল্লা, থানা ও জেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি ভাষণে বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লা।’ এমন দৃঢ়চেতা মনোবল ও ঘোষণার কারণেই পাকিস্তানি শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা পায়।”
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের আরেক সদস্য তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহভাজন ও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও তার প্রেক্ষিত নিয়ে বিভিন্ন লেখায় স্মৃতিচারণা করেছেন। গত শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো একটি লেখায় তোফায়েল আহমেদ বলেন, “১৯৭১-এর ১ মার্চ ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের জন্য হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক চলাকালে পূর্বাহ্নে ডাকা ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। তৎক্ষণাৎ দাবানলের মতো আগুন জ্বলে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা পল্টন ময়দানে যাই। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগ ও ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ) সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেন। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ পাঠ করা হয়। এরপর আসে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। ৭ই মার্চ এক দিনে আসেনি। ধাপে ধাপে এসেছে। এই ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।”
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে স্বাধীনতার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এই ভাষণের মধ্য দিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছি।’ তিনি বলেন, “সেই ভাষণের আগে বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘তুমি মনে রাখবা, তোমার পেছনে বন্দুক তাক করা রয়েছে, আর সামনে রয়েছে জনগণ। তুমি ঠিক করবা তুমি কী বলবা।’ পরে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা মানুষকে দারুণভাবে উদ্দীপিত করেছিল।”
লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণের আগে ১ মার্চেই জনতা পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার পক্ষে মাঠ প্রস্তুত ছিল। বিভিন্ন মহল থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একটা চাপ ছিল। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান তখন জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে গেছেন। তিনি তখন বিরোধীদলীয় নেতাও। তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখানোর জন্য বরাবরই চেষ্টা চালানো হতো। তিনি এই দায় নিতে চান নাই। ফলে ৭ই মার্চের ভাষণে কী বলবেন এটা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’