উৎপল দত্ত: আজও ভোরের বাতাসে বাঙালি বুক ভরে অক্সিজেন নেয়। নগরের নগন্য পাখির কিচিমিচির না চাইলেও কানে সেঁধিয়ে যায়। কংক্রিটির সড়কের পাশে গোপনে বেড়ে-ওঠা নাজুক গুল্ম-লতাটি নজর কাড়তে হাতছানি দেয়। কেউ দেখে, কেউ দেখে না।
এই মানবজমিনের আরেকটি দিন শুরু হয়ে যায় – ক্যালেন্ডার বলে, আজ ২,মার্চ।
যে জমিনে ১৬ কোটি মানুষ ঘুম থেকে ওঠে ক্যালেন্ডারের তারিখ দেখে কর্মক্ষেত্রে ছোটে সে কী তার (!) কথা মনে রেখেছে!
কাউন্ড ডাউন ৭ মার্চ।
মাত্র ৫ দিন।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা একগুচ্ছ সোনালি অক্ষরে ভরে উঠেছিল ৭ মার্চ, ১৯৭১। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির হৃৎপিন্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করা ভাষণ আজ ইউনেস্কোর সেরা ওয়ার স্পিচের একটি – জন্ম দিয়েছিল এই জাতিরাষ্ট্রের।
নাম যার বাংলাদেশ।
যার জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ যার রণসঙ্গীত জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের লেখা – চল চল চল ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণী তল –’
এই ধরণী তলে তারও পা পড়েছিল, ধুলোয় মলিন হয়েছিল। শিশির ধুয়ে দিয়েছিল।
৭ মার্চের গ্রেট ওয়ার স্পিসের প্রতিটি লাইন একটি বাঙালিকে দেয়া প্রস্তুতিমূলক সংবাদ – সুনির্দিষ্টি দিকনির্দেশনা যার ভাষা ও উপস্থাপন নজিরবিহীন। একটি পূর্বাভাষ বা প্রেডিকশন। মুক্তির ঘোষণা-বাণী। প্রচলিত অর্থে ব্রডকাস্টিং ‘অ্যানউন্সমেন্ট’ নয় – তার চেয়েও বেশি কিছু যা হৃদয়ে-মননে ও ধমনীতে ছড়িয়ে যায়।
এই স্পিচকে তাই কবিতার সাথে তুলনা করে ‘পোয়েটিক স্পিচ’ বলা হয়। কবিতায় যেমন আসল কথাটি অন্তরালে থাকে – ইঙ্গিত, প্রতীক ও রূপক আশ্রয়ী হয়ে, ঠিক তেমন। তার শক্তি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার চেয়ে বহু গুণ শক্তিধর। অলিখিত ভাষণটি বাঙালি শ্রুতিতে ও শ্রুতিমাধ্যমে ধরে রেখেছে। একটি হৃদয়-ছোঁয়া কবিতা যেমন বারবার শুনতে ইচ্ছে করে, ৭ মার্চের ভাষণটিও তাই। এর আবেদন চিরায়ত। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির প্রামাণ্য দলিল।
আবার ৭ মার্চে কল্পনার রেসকোর্সে যাবে মানুষ, কানে বাজবে অমর কবিতার অন্তত দুটি লাইন,
‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম –’
বঙ্গবন্ধু অমলিন হেসে মুক্ত ঘাসের ওপর ঠিক রেখে যাবেন তার পায়ের ছাপ। টুঙ্গীপাড়ায় নয়, সারা বাংলাদেশের জমিনে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। জেগেও আছেন।
নাহলে বাঙালি বসন্তে জেগে উঠবে কেন!
মার্চ,২০২১
আরও পড়ুন:
মার্চের মোহন ডাক- (প্রথম পর্ব)