উৎপল দত্ত: প্যানডেমিক-এ বিশ্বজুড়ে কূটনীতির নতুন কৌশল ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিনের ভ্যাপার কূটনৈতিক বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। কূটনৈতিক খেলার মাঠে টপ স্কোরার এখন করোনা ভ্যাকসিন।
কোভিড-১৯ খুলে দিয়েছে কূটনৈতিক খেলার নতুন মাঠ। আঞ্চলিক সম্পর্কের উন্নয়ন, বৈশ্বিক অবস্থানে নিজস্ব স্থান শক্তপোক্ত করা, বাজার বাড়ানো, আমদানি-রপ্তানি চুক্তি – সব কিছুর ধন্বন্তরি হতে যাচ্ছে কোভিড ভ্যাকসিন। পুরনো বিরোধ মীমাংসা, নতুন বিরোধ উসকে দিতেও কাজ করছে ভ্যাকসিন। জনস্বাস্থ্য আর অতিমারি নিয়ে মাথব্যাথা আছে বলে মনে হয় না।
প্রতিক্রিয়ার প্রশ্নে ভাইরাসকে শুরুর থেকেই বিশ্বব্যাপী শক্তি এবং কূটনৈতিক চালের অংশ করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভাইরাসকে সবসময়ই ‘চীনা ভাইরাস’ হিসাবে উল্লেখ করেছে. যার গোড়ায় রয়েছে চীনের সাথে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধ, চীনের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা খর্ব করা।
চীনের সিনোফর্ম কোভিড-১৯ টি ভ্যাকসিনের অর্ধ-মিলিয়ন ডোজ ফেব্রুয়ারির শুরুতে পাকিস্তানে পৌঁছায়। ‘ভ্রাত্রিত্বের বহিঃপ্রকাশ’ – এই অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন পাকিস্তানে অবস্থিত চীনের রাষ্ট্রদূত। তারও আগে কম্বোডিয়া, নেপাল, সিয়েরা লিওন এবং জিম্বাবুয়েসহ আরও ১৩ টি দেশে পৌঁছে গিয়েছিল চীনের সিনোফর্ম কোভিড – ১৯ ভ্যাকসিন।
বন্ধুত্ব ও সমর্থন আদায়ের জন্য পিছিয়ে নেই রাশিয়া। স্পুটনিক ফাইভ রাশিয়ার নিজস্ব আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন। টিকা দান কর্মসূচিতে ব্যর্থ দেশগুলিতে স্পুটনিক ফাইভ সরবরাহে কতোটা আগ্রহ দেখাচ্ছে রাশিয়া, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন উৎপাদিত হচ্ছে ভারতের ল্যাবে। বাংলাদেশ, মায়ানমার, নেপালসহ প্রতিবেশী দেশগুলিতে অ্যাস্ট্রাজেনেকা সরবরাহ করছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার ভাবমূর্তি ভালো করতে পারছে। খ্যাতি বাড়িয়েছে। এই খ্যাতি চীন-ভারত সম্পর্কের অবনতির কালে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে।
বিগত কয়েক মাসে সীমান্তে প্রবেশ-অনুপ্রবেশ নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এখনও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। উদ্বেগ-অনিশ্চয়তার দিন চলমান। ভারত এই সময়ে তার অস্ত্রের মজুদ বাড়িয়েছে। ভারতের অভিযোগ চীন বারবার তার গায়ে ওপর এসে পড়েছে। যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধ এখনও হয়নি। অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে ভ্যাকসিন।
তীব্র উত্তেজনার সময়ে ভারত চীনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছে। ভ্যাকসিন কতোটা করোনা মোকাবেলা করতে পেরেছে তা অস্পষ্ট হলেও আঞ্চলিক সম্পর্কের ভারসাম্যের ওপর ভ্যাকসিন ভালো কাজ করছে, এটা স্পষ্ট।
প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করার ক্ষেত্রেও ভ্যাকসিন-কূটনীতি কার্যকর।
চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপ ও আমেরিকার অভিযোগ রয়েছে। আমেরিকা ইউরোপের দেশগুলির অনুমোদিত ও উৎপাদিত ভ্যাকসিন মান সম্পন্ন নয় বলে প্রচার চালিয়েছে চীন ও রাশিয়া।
জানা যায়, কারাবন্দী বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে স্পুটনিক ফাইভ সিরিয়াকে সরবরাহ করার জন্য ইসরায়েল রাশিয়াকে অর্থ দিতেও রাজি।
দরিদ্র দেশগুলিতে চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিনের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে পশ্চিমের দেশগুলি রাশিয়া ও চীনের দায়বদ্ধতার প্রতি বিশ্বাসযোগ্যাতা হারায়। ভ্যাকসিন বা সহমর্মিতা নয় কূটনৈতিক স্বার্থই চীন ও রাশিয়ার কাছে মুখ্য এমন অভিযোগ তুলেছে অনেকেই। ভ্যাকসিন না পেলে চীন বা রাশিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়ে কী লাভ!
প্যানডেমিক যায়নি। ভ্যাকসিন করোনার আগ্রাসনকে প্রতিহত করলেও ভাইরাসটি থেকে যাবে। এরকমই বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দরিদ্র অথবা টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণে অক্ষম দেশগুলি ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। এই ভ্যাকসিন কী তাহলে আদৌ ভ্যাকসিন নাকি নোভেল করোনার মতো নোভেল কূটনৈতিক অস্ত্র তা খতিয়ে দেখছেন সচেতন রাজনৈতিক মহল।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক