দেশজুড়ে বেড়েই চলছে শীতের প্রকোপ। এবং এই শীতের সাথে নিরবেই কষ্ট বুকে চেপে ধরে লড়ে চলছেন অনেকেই। ঠিক তেমনি এক দৃশ্যের দেখা মিলল খুলনার কয়রা উপজেলায়। নদীর পাড়ে বসে শুকনো পাতা কুড়িয়ে বস্তায় ভরছিলেন বৃদ্ধা নীলা কয়াল। শীতের বিকেলে বাড়ি থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে এসেছেন। শরীরে শীত নিবারণের মতো গরম কাপড় নেই। ঠান্ডা বাতাসে কাঁপছিলেন তিনি।
কাছে গিয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘এই একখান কাপড় আছে। রাত্তির বেলা এই কাপড়ের পরে খ্যাতা (কাঁথা) পেচায়ে শুয়ি থাকি। শীত লাগলিও উপায় তো আর নেই। এই পাতা জ্বালায়ে বাড়িত রান্ধা-বাড়ার সাথে আমাগের শীত নিবারণও হবে।’
খুলনার কয়রা উপজেলার বড়বাড়ি গ্রামে নীলা কয়ালের বাড়ি। স্বামী সুপদ কয়ালের মৃত্যুর পর দুই ছেলের অভাবের সংসারে পালা করে থাকা ও খাবার পান তিনি। এক মাস পরপর ঘরের বারান্দা পরিবর্তন করতে হয় তাকে। সেই সঙ্গে নিজের সম্বল বলতে কয়েকটা ছেঁড়া কাপড় আর কাঁথা-বালিশও স্থানান্তর হয়।
স্থানীয়রা জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক কষ্টে দুই ছেলে রবি ও শশীকে বড় করেছেন তিনি। পরে ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা হয়েছে। তাদেরও টানাটানির সংসার। তার ওপর আম্পানে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন খুপরি ঘরে শীতে কষ্ট পায় সবাই।
নীলা কয়ালের মতো এই শীতে গরম কাপড়ের অভাবে উপজেলার আম্পান বিধ্বস্ত গ্রামগুলোতে কষ্ট পাচ্ছেন মানুষ। আম্পানে সহায় সম্বলহীন মানুষ শীতের শুরুতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুস্থ পরিবারের অনেকের গরম কাপড় না থাকায় কাজেও যেতে পারছেন না। সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা করা হলেও এখন পর্যন্ত শীতবস্ত্র সহযোগিতা পৌঁছায়নি। ফলে বয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে এরই মধ্যে শীতজনিত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম জানান, আম্পানের পর ইউনিয়নের বেশিরভাগ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন। তারা উচু বাঁধে খুপরি ঘরে বাস করছেন। শীতে তাদের কষ্টের শেষ নেই। এসব অসহায়ের কথা বিবেচনা করে সরকারি সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বাঁধের ওপর বসবাসকারী হতদরিদ্র মানুষ জোয়ারে ভেসে আসা সুন্দরবনের গাছের পাতা কুড়াতে ব্যস্ত। তারা জানান, রান্নার পাশাপাশি রাতে ও সকালে শুকনা পাতা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করা হয়।
কাটমারচর গ্রামের বৃদ্ধ কাদের শেখ বলেন, ‘এবার অনেক আগেরতে শীত আরাম্ভ হয়েচে। এমনিতে শীতি কাবু হইয়ে গিছি। তার ওপর নদীর ঠান্ডা বাতাস হু-হু করি বেড়ার ফাঁক দে ঘরে ঢোকে, তখন ছেঁড়া খ্যাতা গায়ে দি কোঁকড় মাইরে থাকি।’
একই গ্রামের বৃদ্ধা নাদিরা খাতুন বলেন, ‘ছেলেপুলেরা মাঝেমধ্যি পাতা পোড়ায়ে আগুন জ্বালায়। তখন এট্টু হাত-পা গরম করতি পারি। কী করব কাপড় যা এক-আধখান ছেলো, তা বানের পানিত ভাসি গেছে।’
স্থানীয় বড়বাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল বাসার বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এই এলাকায় অভাবী মানুষের বসবাস। দুর্যোগে নিঃস্ব হয়ে শীতের শুরুতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। গরম কাপড়ের অভাব, এমনকি পরনের কাপড়েরও অভাব তাদের। এ অবস্থায় সরকারিভাবে তাদের সহযোগিতার দাবি জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, সরকারিভাবে শীতবস্ত্র এখনও এসে পৌঁছায়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তালিকা করতে বলা হয়েছে। শীতবস্ত্র পৌঁছালেই সঙ্গে সঙ্গে তা বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণের জন্য।
সুত্র: সমকাল