যে বাঙালি সন্তানেরা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন তাদেরই একজন আবদুল হামিদ। তবে ভাগ্য বিড়ম্বনায় ভিক্ষা করে জীবন কাটছে এ মুক্তিযোদ্ধার। বসবাস করেন সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের পরিত্যক্ত গ্যালারির নিচে পলিথিন ঘেরা ঝুপড়িতে।
আব্দুল হামিদ সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের নাংলা গ্রামের হারেজ মোল্লার ছেলে। একাত্তরে তিনি খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি গ্রামে নানাবাড়ি থাকতেন। সেখানকার হায়াতখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়তেন তিনি। পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর গ্রামের আব্দুল কাদেরের আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এ বালক।
ভারতের বহেরায় মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন আবদুল হামিদ। পরে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েন বীর এ মুক্তিযোদ্ধা। ৮ নম্বর সেক্টরে তার কমান্ডার ছিলেন মেজর জলিল। সে বাহিনীর সদস্য হিসেবে তিনি খুলনার চুকনগর, খুলনা ও বাগেরহাটের বেশ কয়েকটি স্থানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। কয়রার আব্দুল জব্বার ও কেরামত আলী ছিলেন তার সহযোগী।
যুদ্ধের পর ১৯৭৮ সালে আশাশুনির প্রতাপনগরের রুইয়ার বিলের মান্দার সানার মেয়ে মোমেনাকে বিয়ে করেন এ মুক্তিযোদ্ধা। তবে সাংসারিক জীবনে নিঃসন্তান এ দম্পতি। স্থানীয় মেম্বরের কথায় নাংলা গ্রাম ছেড়ে ৩৫ বছর আগে থেকে সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামের পরিত্যক্ত গ্যালরির নিচে পলিথিনের ঝুপড়িতে বসবাস শুরু করেন এ দম্পতি। জমি নিয়ে মামলায় মাঝে মাঝে গ্রামে যান। তবে চার বছর ধরে শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এ মুক্তিযোদ্ধা। এখন আর স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না তিনি। স্ত্রী মোমেনা তাকে নিয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালান। স্টেডিয়ামের ঝুপড়ি থেকে অনেকেই তাদেরকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে প্রয়াত আইনজীবী অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী তাদেরকে এ স্থানে থাকতে সাহায্য করেন।
এখন আর বয়সের ভারে ও অসুস্থতার কারণে লাঠিতে ভর করে ভিক্ষা করে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আর ওষুধ কিনে খাওয়াতো সেখানে বিলাসিতা। তাছাড়া ঝুপড়িতে গরম কাপড় ও মাদুর না থাকায় মানবেতর জীবন কাটছে হামিদ দম্পতির। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো যুদ্ধকালীন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য দালিলিক কাগজপত্র যা পেয়েছিলেন, তা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম নেই এ মুক্তিযোদ্ধার। পান না কোনো সরকারি ভাতাও।
মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ এখন খানিকটা অপ্রকৃতিস্ত। কিছুক্ষণ কথা বলার পর সারা শরীর কাঁপতে থাকে তার। তিনি বলেন, শেষ বয়সে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। প্রয়োজনে তার সম্পর্কে যাচাই করে দেখা হোক। অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকতে চান না তিনি। ফিরে পেতে চান তার পৈতৃক ভিটাও।
সরকারি কোনো ভাতা না পেলেও করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তাকে দুবার চাল দিয়েছে বলে জানান তিনি।
স্ত্রী মোমেনা খাতুন বলেন, স্যাঁতসেঁতে জায়গায় থেকে তার স্বামীর শরীর ভেঙে পড়ছে। এখন ভিক্ষা করতে নিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে তার পক্ষে। স্বামী মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা পেলে তিনি খুশি হবেন। পেতে চান থাকার মত একটু জায়গা।
আব্দুল হামিদের কষ্টের জীবন দেখা যায় না জানিয়ে সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোলের স্টেডিয়ামের পাশের কয়েকজন দোকানি বলেন, সরকারের কাছে এ দম্পতির আশ্রয় দাবি করেন তারা।
এদিকে আশাশুনির আনুলিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোক্তার হোসেন বলেন, আব্দুল হামিদ নামের কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম তাদের জানা নেই। তাছাড়া দীর্ঘদিন কয়রা ও সাতক্ষীরায় বাস করা আব্দুল হামিদকে তাদের চেনার কথা নয়। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি।
বিষয়টি জানার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানান আশাশুনি উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল হান্নান। তিনি জানান, সহযোগী হিসেবে কয়রার মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলী ও আব্দুল জব্বারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলে অবশ্যই যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য তিনি সব ধরণের চেষ্টা করবেন।
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মীর আলিফ রেজা বলেন, আব্দুল হামিদ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে ইতিমধ্যে তিনি উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যদি তিনি মুক্তিযোদ্ধা নাও হন তাহলেও তাকে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর গৃহ প্রকল্পের আওতায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ