১৭৪০ খ্রিস্টাব্দ। আপনি ব্যবসার কাজে উত্তর ভারতের কোনো জায়গায় গিয়েছেন। সেখান থেকে কাজ শেষ করে রওনা হয়েছেন অন্যত্র। একা একা ঘোড়ার গাড়ি বা হেঁটে যাচ্ছেন। সঙ্গে টাকা-কড়ি বেশ ভালোই আছে। আপনার ভয় লাগছে- ডাকাত ধরবে নাতো! কিছুদূর এগিয়ে আসার পর কয়েকজনকে দেখলেন। তারাও হয়তো আপনার মতই ব্যবসার কাজে বেরিয়েছে। দেখে আপনার ভয় কেটে গেল! তাদের সঙ্গী হলেন। তাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। ওদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলেন লোকগুলো খুবই ভালো। সন্ধ্যা নামতেই ছোট তাবু ফেলে, পাশেই রান্নার আয়োজন শুরু হলো। কয়েকজন গান-বাজনাও শুরু করে দিল। কিন্তু হুট করেই বুঝলেন কেউ একজন আপনার গলায় কিছু একটা পেঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়েছে। সুযোগ পেলেই নিরীহ, একাকী পথিকদের গলায় ফাঁস দিয়ে মারতো এই ঠগী সম্প্রদায়!
এই্সব খুনীদের নিয়ে বিশেষত ঠগীদের নিয়ে বই “ঠগী”। লিখেছেন শ্রীপান্থ। শ্রীপান্থ ১৯৩২ সালে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় সাংবাদিক। ঠগীদের বিস্ময়কর জীবানাচার, ধর্মবিশ্বাস ও খুন সম্পর্কে তার এই “ঠগী” বইটি অনেক তথ্যপূর্ণ।
শ্রীপান্থ “ঠগী” গ্রন্থে বলেছেন, ‘ওরা হৃদয়হীন মানুষ, ইতিহাসের হিংস্রতম, নিপুণতম খুনী- ওরা ঠগি।’ তিনি তাদের খুনের উপকরণ নিয়ে লিখছেন: ‘উপকরণ অতি সামান্য। ঢাল নয়, তলোয়ার নয়, বোমা-পিস্তল-কামান-বন্দুক- কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নয়, একমাত্র হাতিয়ার সেই হলুদ রঙের রুমাল। রুমাল নয়, ওরা বলত ‘পেলহু’। কিংবা সিকা। খুলে রাখলে মনে হবে যেন পাগড়ী খুলে রাখা হয়েছে, অথবা ‘সাস’- কোমরবন্ধনী হিসিবে ব্যবহৃত কোনো কাপড়। দু’ভাঁজে ভাঁজ করার পর সেটির দৈর্ঘ্য মাত্র তিরিশ ইঞ্চি। আঠারো ইঞ্চি দূরে একটি গিঁট। গিঁটের প্রান্তে একটি রুপোর টাকা বাঁধা। নয়তো তামার একটি ডবল পয়সা। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে মেপে মেপে অতি যত্নসহকারে ওরা যখন সেটি তৈরি করে, তখন দেখলে কিছুই বোঝা যাবে না। রুমালটা আসলে একটা ফাঁস। প্রান্তে বাঁধা সিঁদুর মাখানো টাকা ফাঁস আরও নির্ভুল, আরও নিটোল করার জন্য।’
নিচে তুলে ধরা হলো আরো অনেক ধরণের ঠগীদের বিবরণ।
ঠগী: এরা মানুষ খুন করত। সাধারণত বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে বের হত দল বেঁধে। তাদের একজন দেবী ছিলেন এবং ছিল কিছু কঠোর নিয়ম। ঠগীরা সেসব নিয়ম মেনে চলত। পথচারীদের সাথে প্রথমে বন্ধুত্ব করত এবং তারপর মেরে মাটির নিচে পুঁতে রাখত।
ধুতুরিয়া: এরাও খুনী। তবে ঠগীদের মত নিয়ম মানত না। ধুতুরার বিষ মিশিয়ে মানুষ হত্যা করত বলে এদের নাম ছিল ধুতুরিয়া।
তুসমাবাজ ঠগ –এরা এক ধরনের ভ্রাম্যমান ঠগ। ক্রেয়াগ নামের এক ইংরেজ ঠগী হতে চেয়েছিল। সে কিছু শিষ্য জোগাড় করে মানুষ খুনে নামে। একসময় তার অনেক শিষ্য হয় এবং তারা ছড়িয়ে পড়ে। তারা দঁড়ি দিয়ে বাজী ধরে খেলা দেখাত। সাধারণত বাজীতে হেরে গেলে খুন করত। তাদের যাদুর তামাসাকে বলা হত তুসমবাজী।
মেকফানসা: এরা আরেক ধরণের খুনী। যারা মানুষ খুন করে ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বিক্রি করত।
পাঙ্গু/ ভাগিনা: এরা পানির ঠগী। বিভিন্ন নৌকায় থাকত। পানিপথের যাত্রীদের খুন করে পানিতে ভাসিয়ে দিত। ঠগীদের সাথে এদের মিল ছিল। তবে রক্তপাত ছিল এদের জন্য নিষিদ্ধ। এরা খুন করে মেরুদন্ড ভেঙে দিয়ে পানিতে মৃতদেহ বিসর্জন দিত।